সম্প্রতি ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত আইরিশ বাংলা টাইমসের একটি মুদ্রণ কপি এক ভদ্রলোককে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি বেশ বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অধিকার বলে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। ভদ্রলোক মূর্খ নন। অশিক্ষিত নন। অর্ধ শিক্ষিত নন। শিক্ষিত নন। ভদ্রলোক উচ্চ শিক্ষিত। তার যুক্তি, যেহেতু অনলাইনের যুগ, সব কিছুই এখন হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় তাহলে কেনো তিনি কাগজের বই বা ম্যাগাজিন পড়ে সময় নষ্ট করবেন! মোবাইলের মতো একটি ছোট্ট ডিভাইস থেকে সারা পৃথিবীর সব তথ্য উপাত্ত চোখের পলকেই খুঁজে বের করে নেয়া যায়। যখন তখন যা ইচ্ছে তাই সেখান থেকে পড়া যায়। সময় কাটানো বা বিনোদনের জন্য এর চেয়ে বড়ো মাধ্যম আর কি হতে পারে! বস্তুত ভদ্রলোকের কথার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, মানুষ যেহেতু এখন সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে সুতরাং গাদা গাদা বই পুস্তক বা ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন পড়ার এতো সময় কোথায়!
একজন উচ্চ শিক্ষিত ভদ্রলোকের যখন এই মন মানসিকতা, তার মতো মানুষকে যখন দেখি সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে এভাবে কাবু হয়ে যেতে তখন সাধারণ মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া শুধু ওই ভদ্রলোকই বা কেনো, বলতে গেলে সমাজের সিংহভাগ মানুষই আজ সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্ত। আমরা যাকে বলি এডিকটেড (Edicted)। আমি নিজেও এ এডিকসানের বাইরে নই। আমাদের ছেলেবেলায় সমবয়সীরা এক সঙ্গে মিলিত হলে হৈ হুল্লোর বা খেলাধুলা করে সময় কাটিয়েছি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনা। সবাই ট্যাবলেট বা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এককালে দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে গেলে মানুষ ট্রেন, বাস, লঞ্চ বা বিমানে বসে পত্র পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা গল্পের বই পড়ে সময় কাটাতো। এখন আর সে কালচার নেই। হাতে মোবাইল আছে মানে পৃথিবীর সব আছে। সময়ের একটি বিশাল অংশ মানুষ ব্যয় করে ফেসবুকিং বা ইউটুবিং- এ। কেউ কেউ কিছু পড়তে চাইলেও অনলাইন থেকে পড়ে নেয়। কিন্তু অনলাইনে পড়া আর হাতে একটি বই বা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়া কি এক? স্বাদ কি এক? একটি বই হাতে নিয়ে পড়লে তা হৃদয়কে যেভাবে নাড়া দেয়, যেভাবে ঝাঁকুনি দেয় অনলাইনের কোনো কিছু কি হৃদয়কে সেভাবে রেখাপাত করতে পারে?
আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন জীবনের প্রথম আকবর হোসেনের “অবাঞ্ছিত” উপন্যাসটি বাংলা ঘরে পালিয়ে পালিয়ে একদমে পড়ে ফেলেছিলাম। সেই যে কিশোর ধমনীতে বইয়ের ছোঁয়া লাগলো তা আজও প্রবাহমান। বই যে এতো রোমাঞ্চকর হতে পারে তা বই না পড়লে কেউ বুঝবেনা। “অবাঞ্ছিত” দিয়ে শুরু করেছিলাম। এরপর অদ্যাবধি কতো বই পড়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শরৎ চন্দ্রের “গৃহ দাহ”, “পথের দাবী”, আকবর হোসেনের “কি পাইনি” সেই কবে পড়েছিলাম। অথচ এখনো মনের ভেতরে এগুলো বিঁধে আছে। উঠতি বয়সের প্রাক্কালে ওই বই গুলো যখন পড়তাম তখন এগুলো হৃদয়কে এমন ভাবে আন্দোলিত করতো যেনো সারাক্ষণ তা মাথায় ঘুরপাক খেতো। কয়েকদিন পর্যন্ত ভুলে থাকতে পারতামনা। শয়নে-স্বপনে, কাজে-কর্মে, খাওয়া-পড়ায় এমনকি বাথরুমে পর্যন্ত এগুলো আমার হৃদয়ে চেপে বসতো। বুকটা চিন্ চিন্ করতো। মানুষ প্রেমে পড়লে যেমন প্রেমিকের সামনে প্রেমিকার চেহারা কিংবা প্রেমিকার সামনে প্রেমিকের চেহারা সারাক্ষণ ভাসতে থাকে তেমনি আমার সামনেও বইয়ের কালো বর্ণমালা শোভিত শব্দ ও বাক্যমালা ভাসতে থাকতো।
প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ সুন্দর হয়ে উঠে। আর কেউ বইয়ের প্রেমে পড়লে তার অন্তর সুন্দর হয়ে উঠে। বস্তুত প্রতিটি মানুষের ভেতর দুটো মানুষ বসবাস করে। একটি ভালো মানুষ। আরেকটি মন্দ মানুষ। মন্দ মানুষটিকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য বইয়ের চেয়ে বড়ো অস্ত্র আর কোনোটাই হতে পারেনা। বই মানুষকে সুশীল করে। বিনয়ী করে তোলে। সভ্যতা ও অসভ্যতার পার্থক্য নিরুপণ করতে শেখায়। মানব সভ্যতা বিকাশ ও সুস্থ সমাজ গঠনে বইয়ের বিকল্প নেই। তাইতো টলস্টয় বলেছেন, “জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।”
বইয়ের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের যে বিদ্বেষ ও বই পড়ার প্রতি যে অনীহা তা দূর করতে না পারলে সমাজ যে অচিরেই রসাতলে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডিজিটাল আগ্রাসনের হাত থেকে এ সমাজকে বাঁচাতে হলে মানুষকে বই পড়ার প্রতি আরও বেশি উৎসাহী ও মনোযোগী করে তুলতে হবে। আর এ কাজটি করার জন্য যে কয়টি গৌরবজ্বল পন্থা রয়েছে তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম একটি। কারণ, বইমেলা পাঠকদেরকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। মানুষের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানধারণাকে বিস্তৃত করে তোলে, মানুষকে সুখী ও তৃপ্ত করে। বইমেলার মাধ্যমে একটি দেশের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া যায়। মূলত এটি জ্ঞানান্বেষী অগণিত মানুষের জ্ঞান-তীর্থ।
বইমেলার ধারণা বেশ পুরনো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই বইমেলার বীজ রোপিত হলেও এর আনুষ্ঠানিক আবির্ভাব ঘটে ১৯৭২ সালে। এরও আরও পরে ১৯৮৪ সালে “অমর একুশে গ্রন্থমালা”নাম ধারণ করে মেলাটি সাড়ম্ভরে অনুষ্ঠিত হয় যা ক্রমান্বয়ে বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে আজকের শক্তিশালী অবস্থানে পৌছেছে। আয়ারল্যান্ডে ২০২০ সালে প্রথম বারের মতো যখন বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় তখন ওই বিষয়ের উপর আলোকপাত করে একটি মৌলিক নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাই এর পুনরাবৃত্তি করে আজকের লেখাটির আর কলেবর ঘটাতে চাইনা।
বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে আয়ারল্যান্ডে একদল অগ্রগামী মানুষ তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালান। এরই ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক অনাড়ম্বর পরিবেশের মধ্য দিয়ে ডাবলিনের ডি সি ইউ তে “মহান একুশে বইমেলা” অনুষ্ঠিত হয়। সকল শ্রেণীর মানুষের স্বতস্ফূর্ত আগমনে মেলাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সারাদিন ধরে চলে আড্ডা, কবিতা আবৃত্তি, গান-বাজনা ও শিশু কিশোরদের জন্য চিত্রাংকন সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক কর্মসূচি। ডি সি ইউ পরিনত হয়েছিলো বাঙ্গালির এক মহা মিলন মেলায়। বিল্ডিংটির প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে মেলার হলরুম পর্যন্ত দু পাশ যে রংবেরঙের ছবি, প্রচ্ছদ, ব্যানার ও ফেস্টুনে সাজানো হয়েছিলো তা ছিলো সত্যি হৃদয়গ্রাহী। দিনটা যে কিভাবে ফুরিয়ে গিয়েছিলো তা আড্ডা ও বইপ্রেমিক আগন্তুকরা ঠেরই পাননি। দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যেমন মেলার সার্থকতা ফুটে উঠেছিলো তেমনি ওই দিনটিও এক গৌরবজ্বল ঐতিহাসিক দিনে রূপ নিয়েছিলো।
মেলায় কয়েকটি আকর্ষণীয় বইয়ের স্টলও দেয়া হয়েছিলো। স্টলগুলো দিয়ে যারা এর শ্রী বাড়িয়ে মেলাটিকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করে তুলেছিলেন তাঁরা হলেন যথাক্রমে সর্ব জনাব/জনাবা শায়লা শারমিন নিপা, কামরুন নাহার রুনু, হাফিজুর রহমান লিনকন, রন্টি চৌধুরী, বিশ্বজিৎ কুমার সাহা, মিজানুর রহমান জাকির, শাহ শামিম আহমেদ, আরিফ ভুঁইঞা, সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান ও সাজেদুল চৌধুরী রুবেল।
গত মেলার ধারাবাহিকতায় এবার আবারো দ্বিতীয় বারের মতো আগামী ১৫ মে ২০২২ একই জায়গায় আয়ারল্যান্ডস্থ বাঙ্গালিদের প্রাণের মেলা “অমর একুশে বইমেলা” অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারনে পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়লে আমাদের মেলা সম্পন্নের কার্যক্রম ও সাময়িক ভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। যার ফলে ২০২১ সালে ইচ্ছে থাকা সত্বেও মেলা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। টানা প্রায় দুবছর পর করোনার অস্বাভাবিক তাণ্ডব থেকে পৃথিবী মুক্তি পায়। ফিরে পায় তার স্বাভাবিক চেহারা । মেলাবান্ধব আয়োজক বৃন্দ আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেন। ১৫ মে ২০২২ মেলার তারিখ নির্ধারণ করে এক ঝটিকা প্রস্তুতি সভার আশ্রয় নেন তারা। মেলাটিকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল, সার্থক ও সাফল্য মন্ডিত করে তোলার জন্য ওই সভায় উপস্থিত সুধী ও আয়োজকবৃন্দ বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক ও চমকপ্রদ কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন।
এবারের মেলাটি যে আরও বেশি ব্যাপক পরিসরে জাঁকজমক হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধান উদ্যোক্তা সহ অন্যান্য আয়োজক বৃন্দের স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম স্পৃহা, উৎসাহ উদ্দীপনা ও সোশ্যাল মিডিয়ার সরব প্রচার ও প্রচারণা থেকে সহজেই অনুমেয় যে এবারের মেলাটি অন্য যে কোনো সময়ের অনুষ্ঠানের তুলনায় বাঙ্গালি হৃদয়ে অনেক বেশি তৃপ্তির স্বাদ এনে দেবে।
এ মেলার কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিবাদন। তবে পেছন থেকে যিনি এ মেলার শুভ কামনা করে যাচ্ছেন অহর্নিশ, এ মেলা উৎসবকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে ডি সি ইউ এর ভবন বিনা পয়সায় ব্যবহারে সহায়তার উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শুরু থেকে তাঁকে প্রণতি জানাতেই হয়। তাঁর নামটি শ্রদ্ধাভরে এ লেখায় তুলে না ধরলে লেখাটি অসম্পূর্ণতার দোষে দুষ্ট বলে বিবেচিত হবে। তিনি আর কেউ নন। আমাদের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় এমিরিটাস প্রফেসর জনাব এম এস জে হাসমি। তাঁর মতো এমন গুণী মানুষকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করতে চাইনা। কারণ তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে আমরা নিজেরাই বরং সম্মানিত বোধ করতে সচেষ্ট হবো। তাই এ লেখার মাধ্যমে আমার পক্ষ থেকে, মেলার প্রধান উদ্যোক্তা ও আয়োজক বৃন্দের পক্ষ থেকে সর্বোপরি বাঙ্গালি কমিউনিটির পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
বই কেনো কিংবা বইমেলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কি এ সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জ্ঞান বা ধারণা রাখি। তাই এ বিষয়ে আমি আর নতুন করে বস্তাপচা সস্তা কথা লিখে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাইনা। শুধু এতোটুকু বলবো, ডিজিটাল আগ্রাসনের এ যুগে নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করে তোলা ও দেশীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করে তোলা এবং মহান ভাষা আন্দোলনের গর্বিত ইতিহাসকে এদের সামনে তোলে ধরার জন্য আয়ারল্যান্ডে বইমেলা খুবই জরুরি। তাই “অমর একুশে বইমেলা” কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সার্থক ও সাফল্য মন্ডিত করে তুলতে হবে নিজেদের স্বার্থে। বিশ্বখ্যাত লেখক ওমর খৈয়াম শত শত বছর আগে লিখে গেছেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়।” তাই আসুন, আমরাও দলে দলে, সপরিবারে মেলায় অংশগ্রহণ করে আমাদের প্রাণের মেলাটিকে এমন ভাবে সাফল্য মন্ডিত করে তুলি যাতে সময়ের দাবির সাথে তাল মিলিয়ে এটি হয়ে উঠে অনন্ত যৌবনা।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
লিমরিক
১১ মে ২০২২