জাতিসংঘে ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশের ভেতর দিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইজরাইল নামের কর্তৃত্ববাদী দেশটির জন্ম হয়।
তৎকালিন আরব ভূ-খন্ডে ইহুদীদের এক সময় জ্ঞাতি ভাই হিসেবে ডাকতো ফিলিস্তিনিরা। ইহুদীরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। ১) ইজরাইলী ইহুদী এবং ২) আরব ইহুদী। রাষ্ট্রবিহীন ইহুদীরা তখন ছিলো ছন্নছাড়া ও উদ্বাস্ত। একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য তাদের ছিল অহরহ সংগ্রাম। সেই ইহুদীদের আজ রাষ্ট্র হয়েছে, বিপরীত দিকে ফিলিস্তিনিরা আজ রাষ্ট্র বিহীন।
যদিও বেলফোর ডিক্লেয়ারেশনকে আমরা ইজরাইল রাষ্ট্র তৈরির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জানি। তবে এই ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি গঠনের মূলে ছিলো শেইম ওয়াইজমেন নামে একজন ইহুদীবাদী নেতা।। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক বেশি মাত্রায় ডিনামাইটের ব্যবহার করা হয়েছিল । যার কাছে ডিনামাইট জাতীয় বিস্ফোরক ও বোমা যত বেশি ছিল, সেই যুদ্ধে সর্বাপেক্ষা এগিয়ে থাকত।
একটা সময়ে এসে ব্রিটেনের কাছে ডিনামাইটে ব্যবহৃত কাঁচামাল (Raw material) অ্যাসিটোন (Acetone) কমে যায়। পর্যাপ্ত কাঁচামাল (Raw material) সংকুলনের জন্য বৃটিশরা উদগ্রীব হয়ে উঠে। শেইম ওয়াইজম্যান (Chaim Weizmann) ছিলেন অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করা রাশিয়ায় জন্ম নেয়া একজন ইহুদীবাদী নেতা, যাকে The Father of Industrial Fermentation বলা হয়। তিনি ডিনামাইট তৈরির কাঁচামাল (Raw material) অ্যাসিটোন (Acetone) আবিষ্কার করার জন্য একটা ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পান,যেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। এটি দিয়ে ব্রিটিশরা আরো বেশি ডিনামাইট তৈরীর মাধ্যমে যুদ্ধ যাত্রায় এগিয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে তাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হয়।
এই মহা বিজয়ের প্রতিদান হিসেবে তাকে পুরস্কার দিতে চাইলে শেইম ওয়াইজম্যান ইহুদীদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি করেন। সেটি সময়ের পরিক্রমায় হাজারো ফিলিস্তিনির রক্তের উপর দিয়ে প্রতিষ্টিত আজকের ইহুদীবাদী রাষ্ট্র ইজরাইল। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় শেইম ওয়াইজম্যান হচ্ছেন ইজরাইলের প্রতিষ্টাতা রাষ্ট্রপতি ।
ফিলিস্তিনি একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক ইস্যু। এর চলমান সঙ্কট মোকাবেলা এবং দেশটির বেসামরিক নাগরিক ও শিশুদের রক্ষা করতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ও এর প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান পারেন যথাযথ ভূমিকা পালন করতে। ফিলিস্তিনে ক্রমাগত ইসরাইলি হামলা এবং এই ইস্যুর অতীত-বর্তমান ও তার সম্ভাব্য সমাধানে সবার পূর্বে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্য সর্বাধিক প্রয়োজন ।
মুসলিম দেশগুলোকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ফিলিস্তিনি নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কি? সেখানে নির্ভর করছে অনেক কিছু। অবিভক্ত মুসলিম বিশ্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুর প্রকৃত সমাধান আসবে না। কিংবা প্রয়োজনে যুদ্ধের দিকে ধাবিত হলে সেটি হতে পারে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ;এবং সেটি মাথায় রেখে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একতার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনির বৃহৎ দুটি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে থাকা চলমান বৈরিতা প্রশমন করতে হবে বৃহত্তর স্বার্থে। ইজরায়েলের দখল থেকে ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে হলে ফিলিস্তিনির আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিবেশ স্হিতিশীল রাখতে হবে।
কিন্তুু বিগত কয়েক দশক ধরে মসুলমানদের অন্যতম স্পর্শকাতর ফিলিস্তিনি ইস্যুতে বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলো নিরব এবং শুধু বিবৃতি সর্বস্ব হিসেবে দেখা যাচ্ছে। একমাত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান ঘটনার দৃশ্যপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য স্হাপনের প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তাই এই মুহর্তে এরদোয়ানের উপর নির্ভর করছে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তার বিষয়টি । ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিক ও শিশুদের তুরস্ক ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সুরক্ষার বলয়ে রাখা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প দেখছি না এই মুহর্তে। ন্যাটো সদস্য দেশ হিসেবে তুরস্কের রয়েছে বিশাল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এছাড়া দেশটি ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তিধর দেশ।
এইগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তুরস্কই হচ্ছে ইজরায়েলের সাথে টেক্কা দেবার মত আঞ্চলিক পরাশক্তি দেশ। শত্রুকে বুলেট দিয়ে জবাব দিতে এরদোয়ান যতটা সক্ষম, যুদ্ধ ছাড়া দর কষাকষি করে ফলাফল নিজের অনুকূলে আনতেও প্রচন্ড পারদর্শী সুলতান এরদোয়ান।
এক সময় শুধু অস্র দিয়ে পাওয়ার বা ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়ন করা হতো কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে অর্থনীতি, সমাজনীতি ও অবকাঠামো দিয়েও ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়ন করা হচ্ছে।
হয়তো ফিলিস্তিন এখন নিগৃহীত এবং শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বা ইজরাইলের আগ্রহের জায়গা। তবে যদি ফিলিস্তিনিকে তাদের হারানোর গৌরবের ভূমিতে ফেরানো যায় তাহলে এই ফিলিস্তিনকে নিয়ে রাশিয়া ও চায়না একসময় এগিয়ে আসবে। বিষয়টি যখন গ্লোবাল কন্টেক্সট এর বিষয় হয়ে দাড়াবে তখন পরাশক্তিধর দেশগুলো নিজেদের অবস্থান কখনও ছাড় দিতে চাইবে না।
তাছাড়া ইরানের পর তুরস্ক একমাত্র দেশ যাদেরকে ইজরাইল প্রচন্ড সমীহ করে। তাই যত দ্রুত ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় তুরস্ক হস্তক্ষেপ করবে, তত দ্রুত এই রক্তাক্ত সংঘাত বন্ধ হবে। যে কারণে সবাই চেয়ে আছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দিকে।
পারমানবিক সক্ষমতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত ইরান বড় ধরণের কোনো সংঘাতে ইজরায়েলের সাথে জড়াবে না বলে মনে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে সর্ম্পকের অবনতি না ঘটিয়ে ইরান চাইবে তাদের চুড়ান্ত পারমানবিক সক্ষমতা অর্জন করতে। এটি তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সুতরাং ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরান যুদ্ধের মাঠ পর্যন্ত গড়াবে না।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি সবারই জানা।‘সিরিয়ার ১০ বছরের যুদ্ধ, ইয়েমেনের উপর সৌদি আগ্রাসন, মিসরের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সহিংস পতন, লিবিয়ায় রাজনৈতিক অস্হিরতা এবং লেবাননের তিন বছরের রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে আরবরা ভুলে গেছে ফিলিস্তিনিদের ও তাদের সমস্যার কথা। তারা এখন শুধুই নিজেদের সমস্যা নিয়ে ভাবছে। আরবের অনেকে এখন ইজরায়েলের পরম মিত্র।
সৌদির কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত ওআইসি ফিলিস্তিনি ইস্যুতে কার্যকরি ভুমিকা রাখতে পারবে না এটি এক ধরণের প্রতিষ্ঠিত সত্য। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে পাকিস্তান সর্বোচ্ছ ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর মৌখিক আশ্বাস দেয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে আর মালয়েশিয়ার ভূমিকা এখনও পরিস্কার নয় ?
ইজরাইলের সম্প্রতি সহিংস হামলার মুখে পশ্চিম তীর ও গাজার শিশুদের যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে সেটি নিয়ে ইজরাইলের রাজনৈতিক মিত্ররা কিছুই বলছে না। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার পরও ইহুদী আগ্রাসনকে মার্কিন-বৃটেন-ফ্রান্স ইজরায়েলের আত্মরক্ষা বলে মনে করছে !
বছর ধরে নিরাপরাধ ফিলিস্তিনি সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তরে মানুষ হত্যা করে ডেমোক্রেসি, লিবারেলিজম ও ক্যাপিটালিজমের ডিসকোর্স শিখিয়ে আপনার-আমার মতো বলদকে দিনের পর দিন বলদ বানিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমারা। আর বলদ হয়ে আমরাও তাদের আজ্বা মেনে চলছি।
পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারাহ এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে ইসরাইলি আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ থেকে এবারের হামলার সূত্রপাত হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের প্রথম কিবলা আল আকসায় তারাবির নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় ইজরাইল। এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনির প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের প্রতিরোধকে নির্মুলের নামে গাজায় নির্বিচারে বিমান হামলা শুরু করেছে ইজরাইল। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে ১৮০ জনের উপরে ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক, তার মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক। গাজায় অনেকের বাড়ি ঘর গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে অবস্হিত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্হা আল-জাজিরা সহ এপি নিউজের বহুতলা অফিস ভবন দখলদারদের বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
১৯৬৭ সালের আরব ইজরাইল যুদ্ধের সময় পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয় ইজরাইল। এখানেই অবস্থিত মুসলিমদের প্রথম কেবলা এবং তৃতীয় বৃহত্তম পবিত্র স্হান আল আকসা মসজিদ। ১৯৮০ সালে নগরীর পুরোটা দখলে করে নেয় ইহুদিবাদী দেশটি। আন্তর্জাতিক মহল জেরুসালেমকে ইজরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তারা জোরপূর্বক পবিত্র নগরীটি দখল করে রেখেছে।