আমাদের একুশ ও বইমেলার গল্প – সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

0
988
Shajedul Chowdhury Rubel

আমাদের একুশ ও বইমেলার গল্প
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল


 

কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি বইমেলার কথা বলতে গেলে একুশের কথা চলে আসে। আমাদের ভাষার কথা চলে আসে। আর এ একুশ ও ভাষার কথা বলতে গেলে আমাদের সামনে অতীত চলে আসে। তাই সবাইকে বিনয় ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এ মহিমান্বিত অতীতের কথা একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালন করার যে গৌরব ও সৌভাগ্য অর্জন করেছি তা কোনো সহজসাধ্য বিষয় নয়। আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় তা পেয়ে যাইনি। এ পর্যন্ত আসতে আমাদেরকে অনেক খড়কুটো পোহাতে হয়েছে।

১৯৪০ সালে আমাদের বাঘা নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা’ মি জিন্নাহ ও মি গান্ধীর রাজনৈতিক চাতুর্যের কারনে ভেস্তে যায়। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলেও আমরা কোনো স্বাতন্ত্রিক রাষ্ট্র পাইনি। বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্বেও আমাদেরকে পাকিস্তানের অংশীদার হিসেবে যাত্রা শুরু করতে হয়। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই এ অনুভূতিকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্নে প্রথমেই আঘাত হানেন তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর মি জিন্নাহ। তিনি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে ভাষার উপর আঘাত হানতে চাইলেন। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ লোক বাংলায় কথা বললেও মি জিন্নাহ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জোর করে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনের ছাত্র সভায় বেশ জোরালো ভাষায় বললেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র না না বলে বিক্ষুভে ফেটে পরে। আর এ বিক্ষুভ আন্দোলনের সর্বশেষ স্ফূরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল মিটিং করেন। শহীদ হন সালাম, শফিক, রফিক ও জব্বার সহ অনেকেই। এ আন্দোলনকে পেছন থেকে বেগবান করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠায় ১৯৪৭ সালে গড়ে ওঠা “তমুদ্দুন মজলিস” নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও।

পরিশেষে ১৯৫৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে কানাডায় বসবাসরত দুই গর্বিত বাংলাদেশী নাগরিক রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামের উদ্যোগে আমাদের এ মহান ভাষা জাতিসংঘ কতৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করে।

সুতরাং এ ভাষাকে মনে প্রাণে লালন করা, প্রজন্মের কাছে এর গুরুত্ব পৌছে দেয়া, এর সম্প্রসারণ ও এর গৌরবকে টিকিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সে লক্ষ্যে আমি কিছু কথা তোলে ধরছি।

প্রথমত – “অতি আধুনিক” বা ‘অতি যোগ্য” করে তোলার জন্য নিজেদের স্বকীয়তাকে আমরা যেনো বিসর্জন না দেই।
দ্বিতীয়ত – নিজের ঘর থেকেই মাতৃভাষার চর্চা শুরু করা আবশ্যক। প্রবাসে সন্তান সন্ততির সঙ্গে ইংরেজিতে বাক্য ব্যয় না করে বাংলায় কথা বলাই সমীচীন। বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
তৃতীয়ত – আমরা আমাদের অন্য ভাষাভাষী প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের কাছে একুশের অহংকার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব বিশ্লষণ করে তুলে ধরতে পারি।
চতুর্থত – বাংলা মিশনারি স্কুল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। তা ছাড়া যেসব আইরিশ স্কুলে বাঙ্গালি সন্তানের সংখ্যা যথেষ্ট সেসব স্কুল কর্তৃপক্ষকে সপ্তাহে অন্তত একদিন ক্লাস চালু করার অনুরোধ করা যেতে পারে।
পঞ্চমত- “এসো বাংলা শিখি” অনলাইন প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলা শিক্ষা দানের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।
ষষ্ঠত – ভাষার সম্প্রসারণ ও প্রচারে শহীদ মিনারের বিকল্প নেই। অন্যান্য দেশের মতো আয়ারল্যান্ডও এটি সবিশেষ প্রয়োজন। কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ সহ বাংলাদেশ সরকারকেও এ ব্যাপারে বিশদ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিত।

ভাষা ও বইমেলা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মোৎসর্গ ও বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর ৩২টি বই সাজিয়ে সর্ব প্রথম বইমেলার সূচনা ঘটান। তারপর আর পিছু তাকাতে হয়নি। সেই বইমেলা আজ দেশের দেয়াল ছেদ করে পাড়ি জমিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তারই অনুসরণক্রমে গতবছর ১৬ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডে প্রথম বারের মতো এক ঐতিহাসিক “অমর একুশে গ্রন্থমেলা” অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর করোনা জনিত মহামারী ও সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা আমাদের এ প্রাণের মেলাকে সেভাবে উদযাপন করতে পারিনি।তাই বাধ্য হয়েই আজ ভার্চুয়াল বইমেলা উদযাপনের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এ ভার্চুয়াল বইমেলা উদযাপনে যাদের একনিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে রয়েছে তাদেরকে আমি সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই।

সমাজে কিছু মানুষ থাকেন, যারা নতুন কিছু নিয়ে ভাবেন, নতুন নতুন পথ প্রদর্শন করেন। তাদেরকে বলা হয় পথপ্রদর্শক। আয়ারল্যান্ডের বাঙ্গালি সমাজেও এমন কিছু পথপ্রদর্শক রয়েছেন যাদের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা, সুনিপুণ পরিকল্পনা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এ দেশে বইমেলার যাত্রা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। তবে যিনি এ বইমেলার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও পুরোধা ব্যক্তিত্ব তার নামটি না বললেই নয়। তিনি হলেন, আমাদের সবার প্রিয় গুণীজন জনাব সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান।

বইমেলাকে আমি জ্ঞানের মেলা বলতে চাই। বইমেলা মানেই কেবল বইয়ের সমাহার নয়। বরং লেখক সাহিত্যিক সহ সমাজের গুনীজনের মিলনস্থলের নাম বইমেলা। এ মেলায় পাঠক-লেখক সবাই মেতে ওঠেন জ্ঞান-গর্ব আড্ডায়। অনুপ্রাণিত হন বই কেনা-বই পড়ায়। সুতরাং বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে বইমেলার ইতিবাচক প্রভাব ও অবদান যে অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আয়ারল্যান্ডস্থ বাঙ্গালি সমাজের জন্যও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের মেধার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য আমাদের এ বইমেলাকে নি:স্বার্থ ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে যাতে তা একদিন বিশাল মহীরুহে পরিনত হয়।

লেখক- কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিসট

shajed70@yahoo.com

Facebook Comments Box