আমার বড়ো মেয়ে সাইয়েরাহ চৌধুরীর শুভ জন্মদিন আজ। নানা নানি সোহগী কণ্ঠে তাকে রাইতিক সোনা বলে ডাকে। আবার দাদী “খাসাসোনা” ভেবে নাম রেখেছে স্বর্ণা মনি। আমি আদর করে নাম দিয়েছিলাম স্মিতা। “স্মিতা” নামটি অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই রাখা হয়ে গিয়েছিল। তিন-চার মাস বয়সে তাকে কোলে নিয়ে আমি যখন আহ্লাদি ভাষায় তার সঙ্গে রাজ্যের কথা বলছিলাম তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্মিত হাসি উপহার দিচ্ছিল। রবীন্দ্র নাথের কোন এক লেখায় “স্মিত হাসি” শব্দটি পড়েছিলাম। তাই তার মাকে ডেকে বললাম, তোমার মেয়ে রবি ঠাকুরের “স্মিত হাসির” মতোই যেহেতু হাসছে সেহেতু আজ থেকে তার নাম স্মিতা। ব্যাস! তখন থেকেই সবার কাছে এ নামে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু নামকরনের কিছুদিন পরই জানতে পারলাম স্মিতা প্যাটেল নামে এক ভারতীয় চিত্রনায়িকা ছিলেন যিনি বেশ আগেই পরলোকগত হন। এটা শুনার পর থেকেই কেন জানি এ নামে ডাকতে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেললাম। কথা প্রসঙ্গে একদিন এক পাকিস্তানি শরিফা মহিলার সঙ্গে এ ব্যপারে কথা হলে তিনিও নামকরণের ক্ষেত্রে বেশ সাবধানী হওয়ার পরামর্শ দেন। এও বলেন, ভাল বা ইসলামিক নাম কেবল খাতা-পত্রে বন্দি করে রাখার জন্য নয়, বরং যে নামে আমরা কাউকে সবসময় ডাকি সে নামটাই যথার্থ সুন্দর, ধর্মীয় ও অর্থপূর্ণ হওয়া উচিত। তাই অনেক ভেবে চিন্তে এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে “স্মিতা” নামটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সাইয়েরাহ নামে তাকে ডাকতে শুরু করি ও আত্মীয়স্বজন সহ পরিচিত সকলকে এ নামেই ডাকতে অনুরোধ জানাই।
সময়ের সিড়ি বেয়ে আমার মেয়ে আজ তেরো বছরে পা রাখলো। এখন সে আর আগের মতো সেই ছোট্ট শিশুটি নেই। ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার মতো দুরূহ ও দুঃসাধ্য বিষয়টি খেলা করে বেড়ায় তার কচি হৃদয়ে। করোনার ভয়াবহতা তখনো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েনি। চীনের উহান পর্যন্তই বিস্তৃত ছিলো এর মরণ কামড়। ভ্যাকসিন না থাকায় সেখানে প্রতিদিন শত শত লোক মারা যাচ্ছিলো। ওই সময় একদিন তাকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে ফিরছিলাম। গাড়িতে বসে সহসা বলে উঠলো, ” বাবা বড়ো হয়ে আমি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে চাই।” হুট করে ভ্যাকসিন কেনো মা? বললো, “ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারলে মানুষ বাঁচবে। তারা আমার জন্য দোয়া করবে। আর এটাই হবে উত্তম মানব সেবা।”
তার এমন বুদ্ধি দীপ্ত হৃদয়স্পর্শী কথা আমাকে বেশ অভিভূত করে। স্বপ্নের মতো মনে করিয়ে দেয় সব। এইতো সেদিন তার মা তাকে পেটে নিয়ে হাঁটছে, ঘুরছে, ডাক্তার দেখাচ্ছে, সংসারের যাবতীয় কাজ করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই যেন আমার চোখের সামনে দিব্যি ভেসে উঠতে লাগলো। সত্যি সময়ের উপর কারো হাত নেই। সময় বোধ হয় এভাবেই “বহিয়া’ যায়—
২০০৭ সালের ২৫ মে। সারাক্ষন মেঘের কান্না আর ঘোমরাচ্চন্ন প্রকৃতির মুখে হাসি ফুটিয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করে পুবাকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠলো সোনালী সূর্য। আইরিশ আকাশে এ সূর্যের সাক্ষাৎ খুব কমই মেলে। সূর্যারশ্মির কিরণে চারপাশ ঝলমল করছিলো। এমনি এক উজ্জ্বল আলোকিত সকাল। ৮টা ২৪ মিনিট। আমাদের কোলকে আলোকিত করে সুতীব্র চিৎকারের মাধ্যমে তার আগমনের বার্তা জানিয়ে দিলো পৃথিবীকে।
চাঁদের মতো সোনামুখটি দেখে সকল দুঃখ, যন্ত্রনা, নির্ঘুম রাতের জ্বালা মুহূর্তেই উবে গেল কর্পূরের মতো। আইরিশ নিয়মানুযায়ী, প্রসবকৃত সন্তানটিকে সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বুকে শুইয়ে দেয়া হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আবেগঘন এ দৃশ্যটির মাঝে আমরা মা বাবা দুজনই কান্না সংবরন করতে পারিনি। তবে এ কান্না বেদনার ছিলোনা, ছিল সুখের। সাফল্যের। মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের গৌরবের।
আমাদের ফ্যামেলি ডাক্তারের দেয়া তারিখ অনুযায়ী ২৩ তারিখেই আমার মেয়ের জন্ম হওয়ার কথা ছিল। আমার স্ত্রীর গর্ভকালীন সময়ে প্রেসার একটু বেড়ে যায়। ২১ তারিখে মেটারনিটি হসপিটালে নিয়মিত চেক-আপে গেলে প্রেসার জনিত কারণে মা ও শিশুর ঝুকির কথা বিবেচনায় এনে ওইদিনই ডাক্তার তাকে হসপিটালে ভর্তি করে রেখে দেয়। এবং ২৩ তারিখের মধ্যে যে কোন সময় সন্তান প্রসব হওয়ার জোরালো সম্ভাবনার কথাও আমাদেরকে জানায়। ২২ তারিখ সন্ধায় এক নাইজেরিয়ান ডাক্তার আমাকে এসে বলল, আজ রাত দুটোর মধ্যেই তুমি তোমার সন্তানের মুখ দেখতে পাবে।
যে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় একটি গাছের পাতাও নড়েনা, যিনি অন্তরাল থেকে জন্ম মৃত্যু নিয়ন্ত্রন করেন কিংবা যার অপার মহিমায় শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মার বুকে সন্তানের খাবার চলে আসে সেই মহান শক্তিধর পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালাকে উপরে রেখে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বা চিকিৎসা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে একজন ডাক্তার যখন কাউকে এভাবে নিশ্চিত আগামবার্তা জানিয়ে দেয় তা মেনে নেয়া কতোটুকু সমীচীন? জানি, নবাগত সন্তানের মুখ দর্শন করার জন্য প্রতিটি মা বাবাই অধীর আগ্রহে থাকেন। প্রথম সন্তানের মা বাবা হিসেবে এ আগ্রহের মাত্রাটা আমাদের মাঝেও বেশী বৈ কম ছিলোনা। এর পরো কেন জানি ডাক্তারের এমন আগাম আশ্বাসে আমি মোটেও উৎসাহী হয়ে উঠতে পারিনি। তাই তাকে কোন জবাব না দিয়ে কেবল শুকনো হাসি হেসেছিলাম।
অবশেষে ডাক্তার সাহেবের কথা সঠিক হয়নি। ২৪ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত শরীরে পরিপূর্ণ প্রসব ব্যথার উদয় না হওয়া স্বত্বেও আমার স্ত্রীকে ডেলিভারি রুমে স্থানান্থর করা হয়। যে করেই হোক রাতের মধ্যেই সন্তান ভূমিষ্ঠ করতে হবে। বিদেশের মাটি। আপনজন বলতেতো কেউ নেই। সুতরাং আমাকেই ডেলিভারি রুমে থাকতে হল। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ঢুকলাম। বিশেষ শক্তি সম্পন্ন ঔষধ প্রয়োগ করার পর প্রসব ব্যথা বাড়ার সাথে সাথে তাঁর ছটফটানি ও যন্ত্রনাও বাড়তে লাগলো। সে কি অসহ্য যন্ত্রনা! নিজের চোখে না দেখলে কেবল শুনা কথায় সে ব্যথার যন্ত্রনাকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নির্মোহ ব্যথার যন্ত্রনা দেখে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বত্বেও ডাক্তারকে হাই পাওয়ার সম্পন্ন ব্যথা নিরাময়কারী ঔষধ প্রয়গের অনুরোধ জানাই। ভেজা কণ্ঠে মা ও শ্বশুর শাশুড়িকে দোয়া করতে বলি। আমার ময়মনসিংহের মামী সহ তারা সারা রাত আল্লাহর দরবারে দোয়া কামনায় লিপ্ত থাকেন। পরিশেষে টানা পনের ঘণ্টা পর আমাদের কাঙ্খিত সন্তান নতুন পৃথিবীতে এসে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়।
ওই দিনের সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করি, আমাদের দেশেও অন্যদের পাশাপাশি স্বামীকেও তাঁর স্ত্রীর পাশে প্রসবকালীন সময়ে থাকা একান্তই বাঞ্ছনীয়। এতে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর, মায়ের প্রতি ছেলের, বোনের প্রতি ভাইয়ের কেবল ভালোবাসা নয়, স্নেহ-মমতা ও শ্রদ্ধাবোধও বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ বেশী।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম দিনে আমার মেয়ের জন্ম। সে সুবাদে আমার চিটাগাঙের খালা তাকে “অনেক ভাগ্যবতী” বলে উল্লেখ করেছেন। আমার মেয়ে নিজেকে নজরুলের মতো বিখ্যাত মহামানবে দাঁড় করাতে পারবে কিনা জানিনা, তবে তিনি সাম্য ও মানবতার যে গান গেয়েছেন, সে গানের ভেতর যদি নিজেকে সমর্পণ করতে সক্ষম হয়, পিতা হিসেবে সেটাই হবে আমার জন্য গৌরবের, কৃতিত্বের।
বিজাতীয় সাংস্কৃতিক পরিসরে আমার মেয়ে বেড়ে উঠছে। তবু আমি তাকে খাঁটি বাঙ্গালী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জানি, বিষয়টা অনেকটা জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতোই। এর পরো সে যুদ্ধকে আলিঙ্গন করতে চাই আমি। দেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে হবে তার পথ চলা, এই আমার সার্বক্ষণিক কামনা। পিতার এ মনোবাঞ্ছা পুরনের জন্য পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার উপর যেন সমস্থ রহমত বর্ষণ করেন, আজ তার শুভ জন্ম দিনে এই আমার বিনীত প্রার্থনা। সুপ্রিয় পাঠক পাঠিকা দয়া করে আপনারাও আমার সাথে সামিল হন। আমীন।
লেখক- আয়ারল্যান্ড প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও কলামিসট
(লেখাটি ২০১২ সালের ২৫ মে বিডি নিউজ২৪.কম সহ আরও দুটো অনলাইন পোর্টালে প্রকাশ পায়। সেটাই কিছু পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে আজ আবারো প্রকাশ করা হলো।)